জ. ই. আকাশ, হরিরামপুর থেকে :
খেয়া ঘাটে নৌকা আর লগি বৈঠা নিয়ে জীবন যুদ্ধের এক সংগ্রামী নারী চপলা রাণী দাস। মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা নতুন বাজার হতে গোপীনাথপুর মনোপীরের মাঝার বটতলা ইছামতী নদীর ঘাটে ১৮ বছর ধরে মানুষ পারাপার করছেন। স্বামীর রেখে যাওয়া পেশাকেই আকঁড়ে ধরে খেয়া ঘাটের মাঝি হয়ে নৌকা চালিয়ে চার সদস্যের সংসারের মাঝিও তিনি।
জানা যায়, পঞ্চাশোর্ধ বয়স্ক চপলা রাণী দাস উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর উত্তরপাড়া গ্রামের মৃত সুবাস চন্দ্র দাসের স্ত্রী। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে সংসার জীবনে এ দম্পতি ছিলেন চার সন্তানের জনক জননী। বড় মেয়ে স্বরস্বতী রাণী দাস বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। বড় ছেলে সঞ্জীব চন্দ্র দাস। সে পেশায় কাঠমিস্ত্রিরির সহকারী হিসেবে কাজ করে। সে টাঙ্গাইলে বিয়ে করে ওখানেই কাঠমিস্ত্রীরির কাজ করে। ছোট মেয়ে তুলশী রাণী দাস ও ছোট ছেলে আকাশ চন্দ্র দাস এই দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে স্বামীর রেখে যাওয়া চার শতাংশ জায়গার ওপর প্রায় পনের বছর আগে কারিতাসের দেয়া একটি ঘরে বসবাস করেন চপলা রাণী দাস। ঘরটিও টাকার অভাবে মেরামত করতে না পারায় জরাজীর্ণ অবস্থায় বাস করছেন। ১৬ বছর আগে ব্রেণ স্ট্রোকে মারা যান সুবাস চন্দ্র দাস। তখন থেকেই শিশু সন্তানদের নিয়ে স্বামীর রেখে যাওয়া খেয়া নৌকা চালিয়ে সংসারের হাল ধরেন চপলা রাণী সরকার।
ছোট ছেলে আকাশ চন্দ্র দাস। উপজেলার কুটির বাজারে ছোট্ট পরিসরে কাঁচামালের ব্যবসা করে। বাজারের সময়টুকু ব্যতীত বাকি সময় মায়ের সাথেই খেয়া ঘাটে নৌকা চালায়। আকাশ চন্দ্র দাস জানায়, "শিশুকালেই বাবাকে হারিয়েছি। আমার মা এই খেয়া নৌকা চালিয়েই আমাদের মানুষ করেছে। আমি ও আমার ছোটবোন তুলশী গোপীনাথপুর উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পরে টাকার অভাবে আর পড়াশোনা করতে পারিনি। ছোট বোনটির এখন অনেকটা বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের যে অর্থনৈতিক অবস্থা তাতে বোনের বিয়ে নিয়েও খুব চিন্তায় আছি। পড়াশোনা করতে না পারায় আমি ছোটবেলা থেকেই মাকে খেয়া ঘাটে সহযোগিতা করতাম। বর্তমানে নতুন বাজারের কাঁচামালের ব্যবসায়ী শফি ভাইয়ের মাধ্যমে কুটির বাজারে কাঁচা মালের ব্যবসা করি। বাজার ভাঙ্গার পরে আমি বেলা ১১টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত এই খেয়া ঘাটে নৌকা চালাই। আর সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত আমার মা নৌকা চালায়। মূলত আমরা মা ছেলে মিলেই যে যখন পারি এই খেয়া চালাই। " খেয়া ঘাটের আয়ের ব্যাপারে আকাশ চন্দ্র দাস জানায়, "গোপীনাথপুর গ্রামের তিনটি পাড়া থেকে বছরে ১২/১৩ মন ধান পাই। আর এছাড়া প্রতিদিন পারাপারে ৫০/ ৬০ টাকার মতো আসে। আগে এর চেয়ে বেশি হতো। বর্তমানে রাস্তা ঘাট ভাল হওয়ায় এ পথে মানুষজন তেমন আসে না। তাই নগদ টাকাও তেমন হয় না।"
স্থানীয়দের সাথে আলাপ করলে জানা যায়, এক সময় প্রায় ৭/৮ টি গ্রামের মানুষ এই ঘাট দিয়ে পার হয়ে ঝিটকার হাটসহ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করত। গোপীনাথপুর মজমপাড়া, উত্তরপাড়া, উজানপাড়া, কদমতলী, কুটির বাজার, মোহাম্মদপুর, কোটকান্দি, কুশিয়ারচরসহ অনেক এলাকার মানুষসহ স্কুল কলেজের অনেক ছাত্রছাত্রীরাও এই ঘাট দিয়ে পার হয়ে স্কুল কলেজে আসা যাওয়া করত। কিন্তু ঝিটকা- গোপীনাথপুর- বাল্লা রাস্তাটি পাকা হয়ে যাওয়ায় এই ঘাটে বর্তমান পারাপারের চাহিদা নেই বললেই চলে। ৫ বছর আগে এই ঘাট দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার লোকের যাতায়াত ছিল বলেও অনেকে মন্তব্য করেন । বর্তমানে দুইশো থেকে তিনশো লোকের বেশি যাতায়াত হয় না বলেও জানা যায়।
নতুন বাজারের ব্যবসায়ী রাজিব জানান, "রাস্তাঘাট উন্নয়ন হওয়ায় এই ঘাটে এখন মানুষ পারাপারের চাপ নেই। ফলে খেয়া নৌকায়ও আগের মত আয় রোজগার নেই। তারপরেও টুকটাক যা হয়, এই দিয়েই মহিলা খুব কষ্ট করে চলে। ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে খেয়া পারাপার করতেও দেখেছি আমরা। স্বামীর মৃত্যুর পর এই খেয়া নৌকায়ই তাঁর জীবীকার একমাত্র অবলম্বন। এক সময় নদীর পাড়ে টং ঘর তোলে সারারাত নদীর পাড়েও কাটিয়েছেন মানুষ পারাপারের জন্য।"
কাঁচা মালের ব্যবসায়ী শফি জানান, মহিলার স্বামী মারা যাওয়ার পরে ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছে। এক বছর ধরে ছোটছেলে আকাশ চন্দ্র দাসকে আমিই কাঁচামালের ব্যবসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এখন ব্যবসার পাশাপাশি খেয়া ঘাটে খেয়া চালায়। তবে ঘাটের আয় রোজগার এখন আর আগের মতো নেই। এক সময় তো এই ঘাটই অনেক রমরমা ছিল। অনেক লোক যাতায়াত করত। কিন্তু গোপীনাথপুরের পাকা রাস্তা হওয়ায় এই ঘাটের যাতায়াত কমে যায়।
গোপীনাথপুর মজমপাড়ার চুন্নু হাজি জানান, আমরা প্রতি ঈদে নামাজের মাঠ থেকে খেয়া ঘাটের বাবদে টাকা তুলে দেই। এছাড়াও প্রতি বছরে বিভিন্ন শস্য দিয়ে সহযোগিতা করি। দূরের লোকজন পারাপার হলে ৫/১০ টাকা দিয়ে যায়। তবে এখন পারাপারের লোকজন নেই বললেই চলে। ফলে এই মহিলার আয়রোজগারও অনেক কমে গেছে।
চপলা রাণী দাস জানান, "আমার স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায়ই খেয়া চালিয়ে তাকে সহযোগিতা করতাম । অসুস্থ হয়ে তিন বছর ঘরে পড়ে থাকার পর সে মারা যায়। শিশু সন্তান নিয়ে এই খেয়া চালিয়েই অনেক কষ্টে এ পর্যন্ত টিকে আছি। এখন পারাপারের লোকজন তেমন হয় না। সকালে বাজারের সময় কিছু লোক পার হয়। গোপীনাথপুর গ্রামের মানুষ প্রতিবছর ধান দেয়। ঈদের মাঠ থেকেও কিছু টাকা পয়সা তারা উঠায় দেয়। তাদের সহযোগিতায়ই বেঁচে আছি। এছাড়া বিধবা ভাতার একটা কার্ড পাইছি। ছোট ছেলে কাঁচা মালের ব্যবসা করে। পাশাপাশি খেয়া ঘাটেও নৌকা চালায়। সবমিলিয়ে কোনো রকমে চলে। তবে আমার বড় সমস্যা হলো একটা মাত্র ঘর । অনেক আগে কারিতাসের একটা ঘর পাইছিলাম। তাও এখন টিন নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে। তাই সরকারিভাবে একটা ঘর পাইলে দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে কোনো রকম থাকবার পারতাম।"
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, বর্তমানে ঘরের বরাদ্দ খুবই কম। এই মূহুর্তে ঘর হয়তো দেয়া সম্ভব হবে না। তবে, এখন ঢেউটিন ও কিছু নগদ অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।