সুজলা-সুফলা, শষ্য-শ্যামলা আমাদেরই বাংলাদেশ। তার রূপের নেইকো শেষ। এমন অনেক বাক্য ছোট বেলায় বইয়ে পড়তাম কিন্তু বর্তমানে তা উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছি। মনোমুগ্ধকর সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন ভ্রমণ! নীল জলরাশি আর শোঁ শোঁ গর্জনের মনোমুগ্ধকর সমুদ্র সৈকতের নাম কক্সবাজার ও প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন।
আমি বরাবরই ভ্রমণ করা পছন্দ করি। তাই যখনই শুনলাম বিভাগ থেকে ট্যুরে কক্সবাজার আর সেন্টমার্টিন যাওয়া হবে তখনই আমি রাজি হয়ে গেলাম। যদিও বা আমাদের ব্যাচের ৯০ জনের মধ্যে শুধু চারজন গিয়েছিলাম। মনের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বইছে সবার হৃদয়ে। আর সেই সাথে তাল মিলিয়ে গানে আর নাচে উৎসব মুখর ছিল আমাদের এ ভ্রমণ।
সময়টা ২০২২ সালের ২৬ শে মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ কর্তৃক তিন ব্যাচের জন্য (০৩) দিনের একটি ট্যুরের ব্যবস্থা করা হয়। এতে অংশগ্রহণ করে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক সহ। প্রথমত ২৬ শে মার্চ দুপুর ২ টায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে সেন্টমার্টিনের পথে রওনা দেওয়া হয়। তবে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে ডিরেক্ট কোনো গাড়ি দিয়ে সেখানে যাওয়া সম্ভব না। তাই গোপালগঞ্জ থেকে প্রথমে আমরা মাওয়া ঘাটে পৌঁছাই এরপর সেখান থেকে বাসে করে আমরা টেকনাফে পৌঁছাই। এর মাঝপথে কুমিল্লায় ব্রেক দেওয়া হয় খাওয়া দাওয়া করার জন্য। এরপর টেকনাফ থেকে শীপে করে দীর্ঘ ৩ ঘন্টার পথ বঙ্গোপসাগরের বুকে ভাসতে ভাসতে পাড়ি দেই। জাহাজ ছাড়ার পর গাঙ্গচিলগুলো উড়ে আসার দৃশ্য সত্যিই অনেক বেশীই ভাল লাগায়। চিপস, বিস্কুট, রুটি ছুড়ে দিলে একটাও মিস করেনা তারা। নাফ নদী, তার ওপারে মিয়ানমার সীমান্তের সৌন্দর্য এবং বঙ্গোপসাগরের জলরাশি তথা বিশালতা দেখতে দেখতে ২৭ তারিখ দুপুর ১ টায় আমরা সেন্টমার্টিন অবস্থান করি। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মাঝে অসংখ্য প্রবাল রাশি মিলে মিশে একাকার হয়ে তৈরি করেছে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপের নাম হল সেন্টমার্টিন। অনেকে এটাকে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে ও চিনে থাকে। টেকনাফ থেকে নাফ নদী পেরিয়ে জাহাজ যখনি সমুদ্রে প্রবেশ করবে আপনি হারিয়ে যাবেন নীলের এক অসীম আবেশে।
সেন্টমার্টিনে পৌঁছায়ে আমরা সকলে মিলে বীচে অনেক আনন্দ করি এবং ভিজি। এরপর দুপুর ৩টার দিকে হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে যে যার মতো ঘুরতে বেরিয়ে পরি। সত্যি বলতে এমন সুন্দর জায়গা আমি শুধু বই এবং টিভিতেই দেখেছি কিন্তু বাস্তবে দেখে আমি মুগ্ধ। সমুদ্রের পাড়ে বসে শুয়ে রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম আমরা। সমুদ্রের গর্জনের মাঝেও কেমন যেন একটা নীরবতা আছে বলে আমার মনে হয়। এটা বেশ উপভোগ্য বটে! সাগরের পাড়ে হাটতে হাটতে মোটামুটি পুরো সেন্টমার্টিন শেষই করে ফেলছি বলা যায়। আগের দিন সাইকেল চালিয়ে অর্ধেক তো শেষ করেছিলাম, পরেরদিন সকালে বাকি অর্ধেক। এমনিতে খুব বেশী বড় না আসলে এই প্রবাল দ্বীপটি। সেদিনের মতো দিন- রাতটি সেন্টমার্টিনে ঘুরাঘুরি, মজা করেই কাটে। তবে সেদিন রাতে শিক্ষকরা একটি বিনোদনের ব্যবস্থা করেন হোটেলে। প্রতি ব্যাচ থেকে নাচ, গান এবং কবিতায় অংশগ্রহণ করা হয়। সেন্টমার্টিনে যাব কিন্তু বারবিকিউ পার্টি হবেনা তাই কখনও হয়। অবশেষে বিনোদন পার্ট শেষ করে রাতে বারবিকিউ এর ব্যবস্থা করা হয়।
এরপর ২৮ মার্চ সকালে আমরা ছেড়া দ্বীপের উদ্দেশ্য হোটেল থেকে বের হয়ে সাগর পাড়ে যাই। সেখানে সবাই ২ টি ট্রলারে উঠে পরি এবং সাগরের বুক চিড়ে এবং সাগরের পাশে সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পৌছে গেলাম ছেড়াদ্বীপে। সেন্টমার্টিন পুরো যায়গাটাই অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর আর ছেড়াদ্বীপে সেই সৌন্দর্য বোধহয় ঈষৎ পরিমাণে হলেও কিছুটা বেশী। সেখানে এতটাই রোদ ছিল যে টেকা মুশকিল। তাই কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা এবং ছবি তুলে দ্রুত হোটেলের উদ্দেশ্য রওনা দেওয়া হয়৷ হোটেলে পৌঁছে খাওয়া দাওয়া করে এবার কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ি আমরা। কক্সবাজারে পৌঁছাতে রাত প্রায় ১০ টা বেজে যায়। এরপর আমাদের বিভাগের চেয়ারম্যান সানজিদা পারভীন ম্যাম হোটেলেের কর্মরত লোকের সাথে কথা বলে চাবি নিয়ে সব স্টুডেন্টদের রুম বুঝিয়ে দেয়। তবে একটা বিষয় না বললেই নয় যে, ম্যাম আমাদের তৃতীয় ব্যাচের জন্য অনেক কিছু করেছেন কারণ আমরা শুধু ৪ জন গিয়েছিলাম। এতো ঝামেলার মাঝেও সবসময় আমাদের খোজ খবর রেখেছেন তিনি এবং সিনিয়রদের থেকে আলাদা রেখেছিলেন যা দেখে সত্যি আমরা ৪ জন অনেক মুগ্ধ এবং খুশি ছিলাম। এছাড়াও কিছু ভাইয়া আপুর স্নেহ এতোটাই ভালো লেগেছে যা কখনও ভোলার মতো নয়।
এরপর হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে সেই রাতেই আমরা সুগন্ধা বীচে চলে যাই রাতের সমুদ্রের স্রোত দেখতে। দেখতে দেখতেই ২৯ তারিখ রাত ১২ টা থেকে ১২.৩০ পর্যন্ত সেখানে ঘুরেফিরে আবারও হোটেলে ফিরে আসি। পরের দিন আমরা ক'জন খাওয়া দাওয়া না করেই বীচের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরি আর সেখানে অনেক ছবি তুলি এবং বীচে পা ভেজাই। এছাড়াও আমরা ঘোরার পিঠে উঠি যা অনেক ভালো লাগে। মূলত সেই দিনটাই ছিল আমাদের শেষ দিন। এতো অল্প সময়ে কি আর কক্সবাজার ঘোরা শেষ হয়। তবে সেখানে সিনিয়রা যে যার মতো ঘুরছিলেন আমাদের সাথে নেওয়া তো দূরের কথা খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি। এরপর আমরা ৪ জন একা একা এদিকে সেদিকে ঘুরছিলাম। তখনই ২ জন বড় ভাই এবং আপুর দেখা। তারা ঘুরতে যাচ্ছিলেন পথিমধ্যে আমাদের এলোমেলো ভাবে দেখে অটোয় উঠিয়ে নেয় এবং কক্সবাজারের অনেক জায়গা ঘুরে দেখায়। হোবাইব ভাইয়ের বাসা কক্সবাজার এবং সব জায়গা তার পরিচিত তাই তিনি আমাদের অনেক জায়গায় নিয়ে যান। মেরিন ড্রাইভ, হিমছড়ি, ইনানী বীচ, ঝাউ বাগান, মিনি বান্দরবান এমন আরও অনেক জায়গা। মেরিন ড্রাইভের এক দিকে সাগর অন্যদিকে পাহাড়, এমন সব অসাধারণ দৃশ্য। কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই ভাইকে।
২৯ তারিখ দুপুরে হোটেলে ফিরে খাওয়া দাওয়া করে আবারও বেরিয়ে পরি ঘুরতে কারণ রাত ৯ টায় বাস গোপালগঞ্জ তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য রওনা দিবে। আমরা সুগন্ধা বীচে যাই এবং সেখানে সূর্য ডোবা পর্যন্ত অনেক মজা করি এবং ছবি তুলি। কত সুন্দর পরিবেশ, সমুদ্রের স্রোত, চারদিকে মানুষের আনাগোনা। সবাই সবার মতো ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এগুলো ছেড়ে যেন আসতেই মন চাচ্ছিলনা। কিন্তু ফিরতে তো হবেই। তাইতো সন্ধ্যা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত ঘুরে ফিরে অনেক কিছু কেনাকাটা করেছি। এতো স্বল্প সময় কক্সবাজার অবস্থান করায় মন ভরে নি। আর কয়েকদিন যদি থাকতে পারতাম তাহলে হয়তো মনের আশা মিটতো। অবশেষে আমরা রাতে গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরি এবং ৩০ তারিখ দুপুর ২ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় আমরা অবস্থান করি। তবে এই ট্যুর থেকে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। জীবনের একটি বড় পাওয়া হল বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজার ঘুরতে আসা। এখানকার প্রত্যেকটা বিষয়ই ভালোলাগার পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে সুমধুর স্মৃতি আজীবন মনে থাকবে।প্রত্যেকটি বন্ধুকে সাজেস্ট করবো এখানে ঘুরতে আসার জন্য।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।